সোমবার, ২৩ মার্চ, ২০১৫

যন্ত্রবলদ ও আমাদের রক্তক্ষরণ


আমাদের বাড়ি ঘিরে গুণে গুণে সাতখানা ছোটবড় পুকুর ছিল। প্রায় সব বাড়িতেই একেকটা করে। এদের পাড়ে পাড়েই আমাদের নানাকিছু বড় হয়েছে, বেড়ে উঠেছে। সে-সব পুকুর ভরাট হয়ে গেছে। সারারাত ধরে এ যন্ত্রগুলির পাশবিক গোঙানি সহ্য করেছে অসহায় পুকুর। এইসব যন্ত্রবলদের (আমাদের পিতার দেওয়া অভিধা) নীচে চাপা পড়ে গেছে কত রূপসীর স্নান। কিছু করার নেই। মেনে নিতে হবে এই দ্বিধাহীন নগর-আগ্রাসন। তথাপি শেষ পুকুরটির ওপর যখন যন্ত্রবলাৎকার চলছিল ( ১ম ছবিতে) তখন মনে হয়েছে টুঁটি চেপে ধরি। পারিনি।
সেটাই পেরেছেন শিল্পী পুষ্পল দেব। রং আর তুলিতেই তিনি টুঁটি চেপে ধরেছেন যন্ত্রনির্ভর নগরায়ণকে। আমাদের গেরুয়া টিলাগুলি, শ্যামল টিলাগুলি কেটে সমান করে দেওয়া হচ্ছে। রাস্তার প্রয়োজনে, রেলের প্রয়োজনে। যেন যেখানে এইসব টিলাভূমি নেই সেখানে রেল হচ্ছে না, রাস্তা হচ্ছে না। ফাঁকতালে, হারিয়ে যাচ্ছে ত্রিপুরার নৈসর্গিক পরিচয়। এতে যন্ত্রের দোষ কম। কিন্তু সে-ই দৃশ্যমান রাক্ষস। তার মৃত্যুকামনা করেই শিল্পী তাঁর বিরাগ প্রকাশ করেছেন। মৃত্যু তার কিন্তু চারদিকে যে রক্ত ছিটিয়ে আছে, তা কি মানবরক্ত? না মনে হয়। কারণ পট ছিদ্র হয়ে বেরিয়ে আসছে সেই রক্ত। ছবিতে পটের মালিক শিল্পী। সুতরাং এ রক্ত তাঁরই বুকের ক্ষরণ, সেটি বুঝতে অসুবিধা হয় না। আর শিল্পী চিরকালই একটি মানবাতীত সত্ত্বা। তাই শুধু তাঁরই রক্তপাত হচ্ছে না, আকাশের নীল রক্তও ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে সেই পট ফুঁড়ে। বেরিয়ে এসে স্তব্ধ হয়ে মিইয়ে আছে।
আর আছে এক ক্যামেলিয়ন (chameleon)। সে তার দীর্ঘ রসনা ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশের শূন্যতায়। যেন এইসব কাণ্ডকারখানার সে-ই কারক। একদিন তার বর্ণিল দেহটি রক্তশূন্য হবে। ভূমি ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে ছড়িয়ে দেবে তার লোলজিহ্বা। মাটি ছেড়ে সে আমাদের নৈসর্গিক আকাশেরও দখল নিতে চাইবে। সে দিন বড় ভয়ংকর।
সাম্প্রতিককালে ত্রিপুরার কোনও শিল্পীর কাজে এমন কঠোর, নির্মম বাস্তববয়ান, আমি অন্তত দেখিনি। একজন শিল্পীর ব্যক্তিগত রক্তপাত যে কত গভীর ও হৃদয়বিস্তারী হতে পারে, এ তার উদাহরণ। অন্তত আমার কাছে তা মনে হয়েছে। শিল্পীকে ধন্যবাদ।

পুষ্পলের ছবি নিয়ে আবার...
কবিতার ছন্দ স্ক্যান করে দেখানো, অন্যবিধ প্রকরণাদির খোলসা করে দিলে যেমন তার রসহানি হয়, কবির রান্নাঘরে উঁকি মারা হয়ে যায়। তেমনি চিত্রশিল্পীর কাজের জ্যামিতিক সজ্জা, কম্পোজিশনের আগপাশ নিয়ে কথা বললেও, তাঁর অন্দরমহলে উঁকি মারা হয়ে যায়।
সেলিমদার আদেশ পুষ্পলের ছবিটি নিয়ে সে কাজটি করতে হবে আমাকে। ছবিটির গূঢ়জগতে যাবার চেষ্টা করেছি আরেকটি পোস্টে। এখানে তার দৃশ্যমান সৌন্দর্যের কথা বলবার চেষ্টা করব। সাধ্য ও জ্ঞানমত, বলাই বাহুল্য।

পুষ্পল ইদানিং যে শিল্পানুশীলন করছেন, তা ক্ষীণভাবে একটি তত্ত্বের অধীন। সে তত্ত্বের নামোল্লেখ করার প্রয়োজন মনে করি না। শুধু এটুকু বলা যায় এর একটি চিহ্ন ঐতিহ্যানুগমন। এই ছবিটির কম্পোজিশন( শব্দটির বাংলা কী?) নির্মাণ করতে গিয়ে পুষ্পল অতিশয় গতিশীল বারক (Baroque) পদ্ধতিটির আশ্রয় নিয়েছেন। এই পদ্ধতিটির বিকাশ সেই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে। সেই থেকে মোটামুটি ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই টেকনিকটি ইওরোপের শিল্পীদের মাতিয়ে রেখেছে। ত্রিভুজাকৃতির মধ্যে দৃশ্যবস্তুকে সন্নিবেশিত করার মধ্যে যে স্থবিরতা ছিল, যে ধর্মীয় বাধ্যবাধকতা ছিল, তার থেকে বেরিয়ে আসেন শিল্পীরা। যদিও তখনও তাঁরা ধর্মভিত্তিক কাজই করছিলেন, কিন্তু জ্যামিতিক সজ্জার বদল করে ফেলাতে, ছবিতে অসম্ভব আবেগ আর গতির সঞ্চার হল। ছবি যেন পট ছেড়ে দর্শকের সামনে এসে দাঁড়াল। এতকালের দৃষ্টিনিবদ্ধীকরণের যে বিশ্বাস ছিল তাকে নস্যাৎ করে দেওয়া হল। ত্রিভুজাকার সন্নিবেশ থেকে তারা সরে এসে পটের আড়াআড়িভাবে স্থিত (ডায়াগোনাল) একটি কল্পরেখার আশ্রয় নিলেন। সে-ই হয়ে গেল ছবির মেরুদণ্ড, তার থেকে সমকোণে সরে, সমান্তরালে, সমদূরত্বে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণগুলি সাজিয়ে দেন শিল্পী। গুরুত্বপূর্ণ বাঁকগুলি রাখেন। নির্ভুলভাবে। যেন প্রায় স্কেল ধরে ধরে। আসলে তা নয়, শিল্পীর আবেগই তাঁকে দিয়ে এই কাজটি করিয়ে নিচ্ছে।
Baroque composition এর মূল চালিকাগুলির মধ্যে আবেগ ও অসন্তোষ অন্যতম। এই টেকনিক পুষ্পল কত সার্থক ভাবে ব্যবহার করেছেন, তা কিছু ছবির মাধ্যমে বললাম। তুলনামূলক ভাবে। সপ্তদশ শতকে সক্রিয় ইতালিয়ান শিল্পী Guido Reni ছিলেন এই টেকনিকের রাজা। তাঁর দুটো ছবি (২য় ও ৩য় ছবি) আর পুষ্পলের ছবিটির( চতুর্থ ছবি) জ্যামিতিক ইন্টারপ্রিটেশন করে দিলাম। আর একটি ছবি baroque composition এর আগের। সেটি রেনেসাঁ যুগের র‍্যাফায়েলের(১ম ছবি)




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন