অশোক দেব
এই পক্ষের
পাঠ
নতুন,
একেবারে অশ্রুতপূর্ব কোনও সুর সৃষ্টি করা মানুষের সাধ্য নয়। সংগীতশাস্ত্রে এই কথা প্রচলিত।
প্রকৃতিতে যে অপার ধ্বনি
গুঞ্জরিত হয়ে চলেছে, সে-সবের স্মৃতি হতেই ব্যক্তিস্রষ্টা সংগীত রচনা করেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের মত শ্রবণও
আমাদের ইচ্ছা-নিরপেক্ষ। হয়ে চলেছে, কারও দ্বারা
দেহযন্ত্র চলছে। কারও দ্বারা পরিপুষ্ট হচ্ছে ধ্বনিভাণ্ডার। অচেতনে, অবচেতনে। আজকাল নতুন কোনও কিছু পড়তে গেলেই এই কথা মনে
আসে। পাঠদরিদ্র আমি। কিন্তু কোনও একটা নতুন কিছু পড়তে গেলেই মনে নানা কথা ভেসে ওঠে। অস্পষ্ট। বর্তমান পাঠ্যের সঙ্গে হয়তো স্মৃতিতে আসা পূর্বপাঠের কোনওই সম্পর্ক নেই। শুধু যে পূর্বপাঠ মনে আসে
তা নয়। সিনেমার দৃশ্য ভেসে আসে, কোনও চিত্রকরের
কোনও একটি ছবির কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে বাস্তব কোনও বিকেলের ছবি।
বোধ করি
পাঠক হিসেবে অমনোযোগী বলে, একেবারেই নিম্নকোটির পাঠক বলেই
এমন মনে হয়। হোক। তবুও এই অভিজ্ঞতা তো সত্য।
আমারই মনের মধ্যে তার সৃষ্টি ও লয় সাধিত
হল। সুতরাং, অন্যের কাছে তার
কোনও মূল্য থাকুক কি না থাকুক, আমার কাছে তো আছে।
মার্শাল অ্যান্ড ক্যাভেন্ডিস গত শতকের
নয়ের দশকে ‘গ্রেট মাস্টারস’ সিরিজ
বের করে। অসাধারণ কাগজে দারুণ ছাপা গ্রেট আর্টিস্টদের কাজ সেইসব ম্যাগাজিনেই ঠিক মত দেখা।
‘আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়,
জেব্রা যেখানে তার/শাবকদের নিয়ে খেলা
করে।’ এটি একটি
কবিতার বইয়ের প্রথম কবিতার প্রথম পংক্তি। এরকম বই পড়তে বসলেই
জন্ম-জন্মান্তরের স্মৃতি এসে সত্য
হয়ে যায়। প্রায় দৈব-আভিজাত্যে যখন প্রথম
পংক্তি এসে অস্তিত্বে স্থাপিত হয়ে যায়, তখন গ্রন্থই
মায়ার খেলা হয়ে ওঠে। সেই খেলা খেলে অন্য কেউ, আমি পাঠক
কেবল ক্রীড়নক। প্রথম পংক্তিটি এমনই এক জাদুদণ্ড, এমনই
কুশল পরিকল্পনা করেছেন কবি!
যাই হোক, এই প্রথম পংক্তি হতেই শুরু হয়ে গেল খেলা। মনে পড়ে গেল ভিনসেন্ট ভ্যান ঘগের আঁকা ‘আ স্টারি
নাইট’। তখন
তিনি নীল, প্রুসিয়ান ব্লু নিয়ে
মেতে আছেন। একটি নির্জন রাত্রির ছবি। দূরে ঘুমন্ত শহরতলি, ক্যানভাসের বাঁদিকে একটি কী
জানি কী গাছ,
আর দুরন্ত আকাশ। নির্জন। কিন্তু নক্ষত্রগুলো? অস্থির তুলির টানে,
গম্ভীর মনোচারণায় শিল্পী তাদের এঁকেছেন । সারা আকাশে তারা যেন আলোর রায়ট লাগিয়ে দিয়েছে। তারা যেন ব্যক্তি, কিছু বলছে
মর্ত্যমানুষকে। এই দুই
‘নির্জনতা’র মধ্যে
আটকে গেলাম। কবি মজনু শাহ, ‘জেব্রামাস্টার’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম পংক্তিতে এভাবে বিবশ করে
দিলেন। এখানে নির্জনতাকেই মহিমা দিয়েছেন তিনি। এক দূর-গোপন নির্জনতা, অপার বনের
মাঝে সবুজ সেই তৃণাঞ্চল। নিবিড় অপত্যক্রীড়া। এসব সত্য নয়। সত্য এক নির্জনতা। ভ্যান ঘগ যেমন,
আসলে স্বরাট প্রকৃতিকেই ব্যক্তি করেছেন, সেটা নির্জন
রাত্রি, কিন্তু নির্জন নয়। কারণ
নক্ষত্রের উপস্থিতি যেন বেশ সজীব, বাঙময়। কারণ কোনও এক অদৃশ্য অস্তিত্বের কারুকাজে তুলি চলতে
শুরু করে, কিংবা কবির
‘ভাষা তৈরি হয়’। নির্জনতার
এই ব্যক্তিত্ব স্থাপন করে দিলেন বলেই মজনুকে ছেড়ে ওঠা গেল না গত পনেরো
দিন।
‘অস্তিত্বের রঙ কী
- মাঝে মাঝে ভাবি। যেমন কোনো রাজমহিষীকে/ দেখিনি কখনো,
তবু তার মুখের রঙকাহিনি মনে পড়ে। ঐ হাবা/
অরণ্যের পাশে, চুম্বকের বিছানাই আমার সব।
রাত্রিবেলা, প্রান্তরে,/দেখা
দেয় মহাজাগতিক ডিম। হারেমের রূপসীরা সেই দিকে/ দৌড়তে থাকে। সবাই
রঙ পেয়েছে, রসিকতাও। কেবল এই বহু/
ছিদ্রময় অস্তিত্ব, প্রতিমুহূর্তে অস্বীকার করে রঙ, আর সর্বত্র কায়েম/ রাখে তার
অট্টহাসি। সেদিন সাপরাজার সাথে দেখা, বৃত্তান্ত শুনে/
বললেন, এইসব রেখে, কিছুকাল মেঘে মেঘে পায়চারি করুন...’ শিরোনামহীন কোনও এক
মহান সংগীতের নোটেশনের মত করে রচিত
হয়েছে ‘জেব্রামাস্টার’। একের
পর এক কবিতা যেন এসেছে
অমোঘ ধারাবাহিকতায়। উদ্ধৃত কবিতাটি পড়েও সেই স্মৃতি এসে হাজির। একটি শব্দ এল মাথায়,
আরবি, ‘মোজেজা’।
অলৌকিক দৃশ্য। কবিরা কি মোজেজা দেখতে পান?
আটপৌরে শব্দের মালায় কবিতাটিতে মজনু যে গল্পটি বললেন,
তার অর্থ কী? অর্থ খুঁজতে
চাওয়া মানুষের প্রাচীন ব্যাধি। পাথরে শ্যাওলার গড়া অস্পষ্ট অবয়বকে মানুষ দেবতার রূপ দিয়েছে। এদিকে যাব না। বরং ‘অর্থহীনতা’র
আনন্দ উপভোগ করা যাক। অস্তিত্বের রং কী,
এরকম ভাবাতে ভাবাতে কবি আমাদের মোজেজা দেখান। মহাজাগতিক ডিম দেখান। নিজের ভাবলোকে দেখা সেই অলৌকিক দৃশ্যের গল্প বলেন তিনি। বহু ছিদ্রময় অস্তিত্বকে অস্বীকার করে যে রং,
তার কথা বলেন। সে রঙের অট্টহাসি
বেশ শোনা যায়। এর বাইরে গিয়েও
‘রাজমহিষী’, ‘মহাজাগতিক ডিম’,
‘হারেমের রূপসী’ ‘সাপরাজা’, ইত্যাদি
সংকেতকে ভাঙলে একটা অর্থ কিন্তু দাঁড় করানো যাবে। কিন্তু এদের ভাঙাটা হবে আমাদের বাঁধা অভিজ্ঞতার পথ ধরে। কিছুটা
দার্শনিক, কিছুটা ধর্ম মিলিয়ে, কিছুটা কাব্যালঙ্কারশাস্ত্র মিলিয়ে টিলিয়ে একটা সারমর্ম দাঁড় করানো যাবে। তাতে কবির ইশারার জাদু নষ্ট হয়ে যাবে। সে হবে কোনও
কাব্যসমালোচকের কাজ। আমাদের এক অবাক মোজেজা
দর্শনের অভিজ্ঞতা হয় মজনু শাহকে
পড়তে পড়তে।
কোথায় পড়েছিলাম এই মোজেজা
শব্দটি? দূর হতে
বইয়ের সেল্ফের দিকে তাকাই। ঠিক সেই বইটির মেরুদণ্ডে গিয়ে দৃষ্টি পড়ে। সেই নয়ের দশকে কেনা, বহু পুরস্কারে
সম্মানিত ‘অলীক মানুষ’। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। কবে পড়েছিলাম! এবার মজনুর
সঙ্গে অলীক মানুষকেও নিলাম। বদিউজ্জামান নামে এক ফরজি মৌলানার
কথা। নবাবী আমল থেকে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান বিভাজনের প্রায় একশ বছর
কালখণ্ড নিয়ে বিশাল আয়োজন এই উপন্যাসে। নিজেকে কঠোর ফরজি হিসাবে প্রচার করা এক মৌলানার পির হয়ে
ওঠা। সারা উপন্যাসে বদিউজ্জামান হিসেবে তার পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক। একেবারে শেষের দিকে দেখা যায়, বদিউজ্জামান বলে ডাকাতে
তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন। ‘বদি’
হল পাপ, ‘উজ-জামান’ হল কালের।
কালের পাপ। ক্রুদ্ধভাবে মৌলানা বলেন, তার নাম
ওয়াদি-উজ-জামান। কালের নদী। এই একটি নামের
বানান ভেদকে সারা উপন্যাসে ধরে রেখেছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। শেষে তিনি বানানভেদের অর্থের ফেরটি ফাঁস করেন। এতে উপন্যাসটির পরিচয় খোলসা হয়ে যায়। ‘অলীক মানুষ’-এর প্রতিপাদ্য একই সঙ্গে কালের পাপ ও কালের নদীকে নিয়ে। একজন
লেখকের এই মেধাবী পরিকল্পনার সন্ধান পেলে মন
ভিজে ওঠে। অস্তিত্ব নানা রঙে বর্ণিল হয়ে ওঠে চোখের সামনে। জেব্রামাস্টারও এমনই এক পয়াগ্রন্থ হয়ে এসে
ধরা দিয়েছে কবিবন্ধু প্রবুদ্ধসুন্দর করের বদান্যতায়। কারণ, মজনুও একটি কবিতায়
বলেন, ‘আমার কারবার
রুটি ও রাইফেল নিয়ে...’
আবার কয়েক পাতা পরেই বলেন, ‘আমার দুখানি
অস্ত্র - বজ্র ও
তুমি’। না, ‘আমি’ বা কাব্যের
প্রথম পুরুষকে কবি হিসেবেই বিবেচনা করা হচ্ছে না। এই আমি এসে
আমার আমি-র সঙ্গে
মিশ খেয়ে যায় তো।
জেব্রামাস্টার উপমাবহুল। এইসব উপমা ছড়িয়ে আছে সারা বইয়ে, প্রায় প্রতিটি কবিতায়। ‘তখন এক
খণ্ড মেঘ যেন টেলিগ্রাম’, ‘মরুদার্শনিকের মতো
/ চুপচাপ দাঁড়াতে হয় কোনো পান্থপাদপের
কাছে...’ এরকম উজ্জ্বল
সব উপমা। সেখানে উপমান-উপমান্য ভেদ ঘুচে
গিয়ে এক যেন বিমূর্ত
অবয়ব তৈরি করে। একটি তৃতীয় সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়। মজনু এতকাল ধরে চলে আসা ভারতীয় উপমহাদেশের জনপ্রিয় সবগুলি ধর্মের বিভিন্ন শাব্দিক উপাদানগুলিকে ব্যবহার করেছেন। সেটা করেছেন কুশলী কারিগরের মত। জলরঙে আাঁকার সময় শিল্পী যেমন পটের সাদা ছেড়ে দেন, যাকে একটি
রং বলেই মনে হয় দর্শকের। মজনুর মজাটাও এরকম। ‘কৈমাছ আর কাব্যসমালোচকের শেষহীন
দৌড়’ বলে তিনি
টিটকিরি করেন। আবার তিনিই অমোঘ এক প্রশ্ন করেন,
‘মৃত ঘাসের মাঠ, কারা তোমায়
পেরিয়ে যায় প্রতিদিন?’ এই প্রশ্নের
সামনে পড়লে এক অতিলৌকিক সুড়ঙ্গের দরোজা খুলে যায়।
যার কথা কবি বলেন প্রথমেই, ‘কোনো সুড়ঙ্গ
দেখিনি জীবনে, তোমাকে দেখেছি’।
সেই ‘তুমি’ই কি ‘মৃত ঘসের
মাঠ?’ তাকে পেরিয়ে
গেলে কোথায় যায় মানুষ? জৈবমানুষেরই কি ভবিতব্য এক মৃত
ঘাসের মাঠ পেরিয়ে কোথায় হারিয়ে যাওয়া? মনোমানুষকে যেতে হয়
না?
‘Mont Sainte
Victoire Seen From Les Lauves’ পল
সেজানের আঁকা। ভ্যান ঘগেরই সমসাময়িক। রঙের জাদুতে গড়া আবছা পাহাড়, বৃক্ষ,
যেনবা জনপদেরও ছবি। এই মায়া থেকে
যদি কেউ স্পষ্ট করে কোনও স্থানবিশেষকে দেখতে চান, তবে ব্যর্থ
হবেন। ঠিক তেমনি অনুভূতি দিল জেব্রামাস্টার। কবির অক্ষরবৃত্তের মেধাবী প্রয়োগ সত্য, সত্য তার
কাহিনির জালে জালে কাব্যসুষমা ছড়িয়ে দেবার দক্ষতা। সত্য কবির আবহমান বাংলা কবিতাকে আত্মস্থ রেখে পথ চলার সাহস।
কিন্তু এইসব হয়তো শেষ সত্য নয়। অসম্ভব সব মোজেজা, দৃশ্যত
এবং অন্তর্গত, এই প্রাপ্তি
নিয়েই কেটে গেল গত কয়েকদিন। এখনও ভেজা ভেজা লাগছে মন।
দ্র:
উল্লেখিত ছবিগুলির বর্ণনা স্মৃতি থেকে দেওয়া। ফলে একটু এদিক ওদিক হতে পারে। এইসব চিত্রকরদের নানা তত্ত্বের আলোকে ফেলে বিচার করা হয়। ‘জেব্রামাস্টার’কে সেইসব
তত্ত্বের আওতায় ফেলা আমার উদ্দেশ্য নয়।
অসম থেকে প্রকাশিত শিলং টাইমস এর বাংলা কাগজ সংবাদ লহরীর রবিবাসরে প্রকাশিত |
১২ আগস্ট ২০১২-তে প্রকাশিত |
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন